বিসর্জন

পূজো শেষমেষ ভালয় ভালয় কাটল। এবার ঘরে ফেরার পালা।ঢাকে বাদ্যি বাজছে… ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন। বাচ্চাগুলো লাফাচ্ছে…আসছে বছর আবার হবে। ওদিকে লরিগুলোও এসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।ছেলে-ছোকরার দলবল দুগ্গামার পরিবারের সবাইকে তাতে টেনেটুনে তোলার জন্যে প্রস্তুত।দড়ি-দড়া হাতে নিয়ে সেক্রেটারি কাকুর আদেশের অপেক্ষায়। মা আর অসুরের কোমরে বাঁধা হবে।

পূজোর আগে কুমোরবাড়ী থেকে প্যান্ডেলে আনার সময় যত সাবধানতা, যাবার সময় তার কিছুই বাকি থাকেনা। ঠোঁটের ডগায় নাড়ু প্যাঁড়া ঠেসেঠুসে মেকআপ বরবাদ।মায়ের হাতের খড়্গ হ্যান্ডেল ভেঙ্গে একপাশে ঝুলছে হারু পাগলার পাজামার দড়ির মত,  ত্রিশুলের ডগাটা উধাও, আগাটাও টেরেবেঁকে কোনমতে টিঁকে আছে মহিষাসুরের বগলতলার নিরাপদ আশ্রয়ে।

সুদর্শন সেনাপতি কার্তিক হয়েছেন অস্ত্রহীন আর সেই তীর-ধনুকের দখলদারি নিয়ে পাড়ার বাচ্চাগুলো জোরদার মারপিট লাগিয়েছে, অসুরের বড়বড় মূলোর মত  খিঁচোনো দাঁতে জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্যাঁড়ার পুরু প্রলেপ (খাওয়াতে কেউ বাদ রাখেনি কিনা…!)আর দাঁতের ফাঁকে ছোট্ট একটা ফুটো থেকে বোঁটায় লাগানো পানের খিলি ঝুলন্ত। ওপাশে গনেশের নাদুশ পেটে কেউ একজন সিঁদুর মাখানো হাতের ছাপ লাগিয়েছে। গনেশবাবা কিচ্ছুটি বলার সুযোগ পাননি, ছলছল চোখে মা-র দিকে তাকিয়েছেন কেবল। মা-ও সামান্য হেসে বুঝিয়ে দিয়েছেন কি করবি বাবা, আমারও একই অবস্থা। কষ্ট করে আরেকটু সহ্য কর সোনা।

মা লক্ষ্মী তাঁর দুর্মূল্য ঝাঁপিটা খুইয়েছেন, এদিক ওদিক আড়চোখে চেয়ে কোথাও দেখতে পেলেন না। ভাগ্যিস আজকাল ক্রেডিট কার্ড আর এটিএমের যুগ। ঝাঁপিতে তাই ক্যাশ রাখেন না। তবে ঝাঁপিটা ইমপোর্টেড ছিল, স্বয়ং নারায়ণ এনে দিয়েছিলেন বিদেশ থেকে। তাই মনটা ব্যাজার। মার দিকে একবার রাগভরা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলেন কতবার বল্লাম আমি আসবোনা এবার মর্ত্যে, শুনলেনা। আমার আজকাল ভাল্লাগেনা আসতে তুমি তো জানই। এই সময়ে আমার এনআরআই ভক্তরা ফরেন ট্রিপের ব্যবস্থা করেছিল, যাওয়া হল না। জোর করে নিয়ে এলে লোকে কি বলবে সেই ভয়ে। দেখ তো ট্রিপও গেল ঝাঁপিটাও গেল, এখন নারুকে কি বলব আমি? হাও ডিসগাস্টিং!

সরস্বতীর বীণাও হস্তচ্যুত। সেটা নিয়ে একটা ছেলে ক্রিকেটের ব্যাটিং প্রাকটিস করছে।তারগুলো ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। সগ্গধামে গিয়ে বিশ্বকর্মার কাছে নতুন বীণার অর্ডার দিতে হবে আর সে কদিন অগত্যা গিটারেই কাজ সারতে হবে। সিংহের হাঁ-আঁ করা মুখেও কেউ পানের খিলি গুঁজে দিয়ে গেছে।ছ্যাঃ ছ্যাঃ, পশুরাজ পান খাচ্ছে জানলে জঙ্গলে তাকে কেউ মানবে? ছাগলেও ভয় পাবেনা। তবু বেচারা পশুরাজ মুখফুটে কিছু বলতে পারছে না, করুণ চোখে মা দুগ্গার দিকে চাইছে মাঝে মাঝে আর মা অভয় দিয়ে বলছেন, এইতো হয়ে গেছে, এবারেই যাব বাছা, আরেকটু ধৈর্য্য ধর।

ওদিকে টানা এই কদিন সিংহের পিঠ আর অসুরের কাঁধে পা রেখে ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে থাকার পর মায়েরও কোমর টাটিয়ে উঠেছে। ভাবলেন ফিরে গিয়ে অশ্বিনীকুমারকে বলে বেদনা নিবারণী পান্ডু মলম আনাতে হবে মালিশ করার জন্যে।

অসুরের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। সেও মনে মনে প্রমাদ গুনছে আর মহাদেবের কাছে আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছে… হে প্রভু, আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন আমার দুর্দশা। নকল চামড়ার ওপর দস্তার গিল্টি করা বাহারি বেল্টের আধখানা টানাহেঁচড়ায় কোন ফাঁকে খুলে গেছে এবং কোনমতে কোমরের সাথে আপস করে প্রলম্বিত হয়ে আছে। মুহূর্তের হেরফেরে বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কোথায় মুখ লুকোবো প্রভু? হাত দুটোও কাজে লাগবে না। আমার হাতের ঢাল আর তরোয়াল ইতিমধ্যে খোয়া গেলেও মা-র হতচ্ছাড়া নাগরাজ, যা নাকি আপনিই দিয়েছিলেন বলে শুনেছি, আমার হাতদুটোকে নট নড়নচড়ন করে রেখে দিয়েছে। তার ওপর ঘাড়ে মায়ের শ্রীচরণ, মুখের সামনে সিংহের বিকট মুখব্যাদান। তার আবার যা গন্ধ তাতে অন্নপ্রাশনের ভাত উল্টে আসছে। প্যাঁড়ার লোভে তখন থেকে একটা মাছি আবার আমার মুখের সামনে ঘুরঘুর করছে, সেটাকেও তাড়াতে পারছিনা। মোষ বেচারিও কাটা সৈনিক সেজে পড়ে থেকে থেকে বোর হয়ে গেছে। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকতে হলে ওকেও ওভারটাইম দিতে হবে। নাহলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হুমকি দিয়ে রেখেছে। হে প্রভু ত্রাহি মাম্, লাজ রেখো।

তা এমতাবস্থায় সপরিবারে মহাদেব লরি চেপে বসলেন সগ্গে যাবার উদ্দেশ্যে।আগে আগে সারি বেঁধে উদ্যোক্তা ও ছেলে-ছোকরারা চলেছে উদ্দাম নাচ করতে করতে। মাই নেম্ ইজ় শীলা, শীলা কি জওয়ানী…, ঢ্যাঁনটানা টানাটানা…ইত্যাদি গানের তালে তালে। মাইকের গগন-বিদারী আওয়াজে দু-কান ঝালাপালা।

মহাদেব ধ্যানমূর্তি,… দৃষ্টি সুদূর দিগন্তে লীন। ভালয় ভালয় শ্বশুরবাড়ীর দিনক’টা শেষ হওয়ায় বেশ প্রসন্ন কারণ কৈলাশে পৌঁছে আবার গঞ্জিকা কলকেটি হাতে পাবেন। গিন্নির মাথার দিব্যি দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন যাতে সেটি ভুলেও না ছোঁন। তাই সেকথা রাখতে বেশীরভাগ সময়টাই কুম্ভকে কাটিয়েছেন ভোলেনাথ।
যাই হোক, চলতে চলতে অবশেষে গঙ্গার তীর | এবার মায়ের বাড়ি যাবার পালা | প্রথমে মহাদেব, পরে ছেলেমেয়েরা ও সব শেষে মহিষাসুর সহ মাকে জল-বিসর্জন দেওয়া হবে।পাড়ে দাঁড়ানো তুচ্ছ মানুষ গুলোর চোখেও তখন জল। হাত জোড় করে সবাই বলছে আসছে বছর আবার এসো মা, দোষত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা কোরো। পৃথিবীর সবাইকে ভালো রেখো। আর যেন কোনও মায়ের কোল খালি না হয়, অকারণ হিংসায় কারো সিঁথির সিঁদূর মুছে না যায়, অসহায় শিশু অনাথ না হয়…।

মায়ের মুখে তখন শেষ বিকেলের রোদের আভা। তৃতীয় নয়নও যেন চিকচিক করছে ।সব অস্ত্র এদিক সেদিক হয়ে গেলেও একটি হাতে বরাভয় অটুট, তা কেউ নিয়ে যেতে পারেনি। আপামর মর্ত্যবাসীর আর কি চাই!?

মধুমিতা ভট্টাচার্য

This entry was posted in গদ্যের ঝর্ণায়. Bookmark the permalink.

10 Responses to বিসর্জন

  1. Ananya Banerjee Chattopadhyay বলেছেন:

    হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে অবশেষে চোখে জল। সুপারলাইক!!!

  2. ghanada বলেছেন:

    মধুমিতার লেখার জবাব কোনোদিনই পাই নি!
    এবারেও ঝক্কাস লেখা!

  3. swapnavo বলেছেন:

    Asadharon kalom. Jharjhare. Apoorbo goti. Aar, manodik.

  4. মহাশ্বেতা বলেছেন:

    বাহঃ কি ভাল লেখা পড়লাম একটা। বিসর্জনের চোখের জলের মধ্যেও কত না হাসি ঃ) দারুণ!

  5. maitraryi ray sar বলেছেন:

    darun. khub maja pelam.

  6. Geetarashmi বলেছেন:

    Madhumita tar shobhaber motoi jhor jhore er kautuk mistrito lekha lekhe!…proti bari pori er mone mone boli….aro lekh madhu!

  7. sumana saha বলেছেন:

    Ki darun ekta lekha porlaam Robibaarer shokkal belaay! Ki tortorey likhish tui Madhu! Apurbo:)!

  8. অনিন্দিতা মন্ডল বলেছেন:

    কী ভালো যে লাগল !

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান