পূর্ণপ্রভা ঘোষ

পালিয়ে কোথায় যাব

বরাবর ফার্স্ট ‘অরুণ’, ওয়ান থেকেই। ছাত্ররা সমস্বরে, কিন্তু সঙ্গে হিহি, হোহো, খুক্ খুক্ নানান শব্দ। ধমক দিলাম। ‘চুপ! ক্লাসটা শুনেছি ভালো,এসব কী?’

মাথা নিচু সবার।

আগের ক্লাসটিচারের কাছে শুনেছি।

তাকালাম। আমার দিকেই তাকিয়েছিল, চোখ নামাল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাড়িতে পড়ায় কে’? উত্তর নেই, চোখও তুলল না! আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘পড়শোনা কে দেখেন?’ তবুও চুপ।

হয়ত সঙ্কোচ। নয়ত ঢ্যাঁটা।

কথা না বাড়িয়ে পড়ানো শুরু করলাম। সময় দৌড়োচ্ছে, ঘন্টা বাজল ঢং ঢং ঢং। চক ডাস্টার নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে বেরিয়েই ফিরে তাকালাম।

দুষ্টুমিতে ব্যস্ত ছেলেরা, ‘অরুণ’ আমার দিকেই তাকিয়ে! অবাক হলাম!

ছোটবেলা থেকে জীবনকে অনেকভাবে দেখেছি। দৃষ্টি চিনি। অভিজ্ঞতা রয়েছে।
মাস্টার্স পড়ার সময় হস্টেলে থাকতাম। রুমমেট ছিল ‘কল্যাণ’। সবাই ‘কলি’ ডাকতো। পড়াশোনায় সাংঘাতিক, কিন্তু এইরকম দৃষ্টি। অস্থির। বিব্রত ছিল শরীর নিয়ে। অসুবিধে হত আমার। বিরক্তই হতাম।
কথাই শুনত না। বোঝালাম একদিন। বললাম, ‘কেন ছুটছ মরিচীকার পেছনে? অবাস্তব কল্পনা ছাড়ো। নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর’। তাকিয়েছিল অদ্ভুত! কিছুই বলেনি। তারপর তো পড়াশোনার চাপে নাজেহাল।

আমাকে নিয়েও হাসাহাসি ক্লাসে। রুমমেট আমার, উল্টোপাল্টা মন্তব্য আমাকেও। শুনতাম চুপ করে। হাসবে সবাই। কষ্টটা বুঝবে না! বুঝতাম আমি, কষ্টটাকে উপেক্ষা করতে বলতাম তবুও। আমরা বড়লোক নই।

ঘোড়ারোগ সাজে না আমাদের। ওইসব নাটকীয়তাকে প্রশ্রয় দিতে নেই।

কখনও শুনত, কখনও সরে যেত। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আমরা, ফাইন্যাল ইয়ার। রেজাল্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নইলে খেতে পাব না।

ছুটিতে বাড়ি যাই না, কলিও। হোস্টেল প্রায় ফাঁকা।

একদিন রাতে ফিরল না কলি। পরদিনও না। ফোন করলাম, সুইচ্ড অফ। চিন্তা হল, জানালাম সবাইকে। হুলুস্থুলু কান্ড! পুলিশ এল। আমাকেই জিজ্ঞাসা সবার। যতটুকু জানতাম বলেছি।

কেউ সন্তুষ্ট নয়। আমাকে দোষী সাব্যস্ত করল অনেকেই। ঝামেলায় বিরক্ত হলাম। পড়াশোনার বারোটা। কিন্তু কলির খোঁজ পেলাম না। পুলিশও চুপ। আমিও।

রেজাল্ট খারাপ হয়নি। আমার অর্জুনের চোখ, উৎরেছি।

বাড়িতে টাকা না পাঠালেই নয়। অপেক্ষায় না থেকে এপ্লাই করলাম। স্কুলে চাকরি হল। প্রথম ক্লাস। বুঝলাম, এখানেও লড়াই।

বছর দেড়েক, বেশ ছাত্রবন্ধু হয়েছি। ক্লাস টেন-‘এ’র ক্লাসটিচারের দায়িত্বও পেলাম। এখনও স্কুল আমাকে স্থায়ী করেনি, ভরসা করতে পারি, হয়ে যাবে। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম আমায় ডেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। শিক্ষকরাও তাই বলছেন। দেখা যাক। দায়িত্ব পালন করছি কেবল। ভরসা পেলে জান লড়িয়ে দেব।

প্রতিবছরের মত এবারেও অরুণই ফার্স্ট। বিশেষ গর্বের, রেকর্ড মার্কস সব বিষয়েই। টেস্ট পরীক্ষায় একটা নম্বর কোথাও কাটতে পারিনি। বোর্ডের পরীক্ষায় ভালোকিছুর অপেক্ষায় রয়েছি। ওদের ক্লাস শেষ। আরও ভালোভাবে তৈরি হতে বললাম। অরুণের চোখ ছলছল। খুব মিস করবে আমাকে। আমিও।

মায়া পড়ে গেছে ওর উপর। অন্যধরণের টান। নিজেকে বুঝিয়ে ব্যস্ত রাখি নতুন ক্লাসে। চোখ খোঁজে ‘অরুণ’কেই।

ইতিমধ্যে একদিন স্কুলছুটির পরে অরুণের মা এসে প্রায় জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেল। বছরভর সাহায্য করেছি পড়াশোনায়, বাড়ির লোকও খুশি।

‘কলি’র কথা মনে পড়ে। ‘কলি’ ছিল গরীব, কিন্তু চিন্তাভাবনাতে নয়। স্বপ্নের জাল বুনত, থামাতে পারতাম না। অরুণের সেই সমস্যা নেই, প্রসেসের মধ্যেই রয়েছে। বাড়ি থেকে সাপোর্ট পাচ্ছে সম্পূর্ণ।

কিন্তু কী বলছে এইসব?

‘অরুণে’র মুখোমুখি বসেছি। আমাকে না পেলে বাঁচবে না!

ভগবান! কী বলব। বইপত্রে, ফোনে, ডাইরিতে সর্বত্রই আমার চিহ্ণ রাখা। মেডিক্যাল বোর্ড অপেক্ষায়। ওকে ‘অরুণা’ করে দেবে শিগ্গিরি।

আমিও দুর্বল কিছুটা হয়ত। কিন্তু শুধু পড়াশোনায় ওর মনযোগ দেখে। কী বলব? বড়লোকের ছেলের আব্দার?

সময় চেয়ে ফিরে এলাম। ওর মা কাঁদছে। এই নিয়ে অরুণের বাবার সঙ্গেও যুদ্ধ করছেন ভদ্রমহিলা। প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ আকস্মিক! ভুমিকম্পের ধাক্কা। মনটা অস্থির লাগছে। তাহলে ‘কলি’ কী দোষ করল? গরীব আর বড়লোক?

ফোন কেটে দিচ্ছি। বারকয়েক গাড়ি পাঠিয়েছিল, ফিরিয়ে দিয়েছি। অবশেষে স্কুলটাই ছেড়ে দিলাম। শুনেছি, অরুণের বাবা রয়েছেন ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে।

আবার চাকরি খুঁজতে হবে কোথাও। বড্ড খারাপ অবস্থা, বোন পড়াশোনা করছে আমার ভরসায়। মায়ের শরীর খারাপ। সংসারের খরচ, ডাক্তারের খরচ। পাগল পাগল লাগছে। অনেকদিন যাইনি, বাড়ি যাব। ট্রেনে বসেছি, সামনের ভদ্রমহিলা তাকিয়ে। চেনা? মনে করতে পারছি না। কীভাবে সোজা তাকাই? কে?

চমকে উঠি, ‘কলি’? তারপর, তারপর, তারপর!

সম্পূর্ণ একার লড়াই ওর, আজ ও ‘কল্যাণী’।

ওর এনজিওতেই জয়েন করলাম। মুগ্ধ, থাকব সঙ্গে।

আমাদেরকে সমাজ মেনে নেবে না! আবারও লড়াই।

প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, হায়, কোথায় পালাবো!

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s