চন্দ্রাণী বসু

গোপন সুখ

আগ্রার সূর্য অস্তাচলে যাচ্ছে। জাফরি দিয়ে সেই আলো এসে পড়ছে ভারতের শাহেনশা মুঘল বাদশাহ বাবরের মুখে। কোঁচকানো চামড়ার সজ্জা কপালে স্পষ্ট সে আলোয়। চারপাশে ঘেরা সুখেও এ কিসের ভার ? কিসের দ্বিধা তাঁর মনে ? সত্য গোপন করবেন না কি অকপট সত্যের সামনে দাঁড়াবেন তিনি ? যুদ্ধের প্রাঙ্গণে শত্রুর সামনে লড়াই করার কূট – কৌশল, অভিসন্ধির থেকেও এ যে কঠিন সিদ্ধান্ত। বাবরিনামাতে কি, লিখবেন তিনি ? তাঁর এইসব গোপন সুখের কথা ?

স্মৃতির আরশিতে এখনো তার মুখ সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি। জাফরির ফাঁক দিয়ে অন্ধকার নেমে আসছে ক্রমশ। অথচ স্মৃতি এলোমেলো হয়ে বারবার আলোকিত হচ্ছে সেই এক মুখ … অতীত আরো অতীতের কারনামা – বাবরি – সরল একখানা মুখ …

– আদাব ! বাদশা হুজুর ! হুকুম করুন, তলব কেন ? এ বান্দার অপরাধ কি ?
– হাঃ হাঃ ! অপরাধ ? অপরাধ তুমি, তোমার চাহনি, তোমার দেহ। কি নাম তোমার প্রিয় ?
– বাবরি।
– আমার মন এখন তোমার সুর্মায় আটকে রয়েছে। তোমার নজর ম্লান করে দিচ্ছে প্রতিদিনের সুরার স্বাদ। আমি উন্মাদ হয়েছি বাবরি তোমার প্রেমে। কাছে এস – একবার আরো কাছে …
– জাহাপনা ! আপনি শাহেনসা, আপনি বাদশাহ। আমি আপনার হারেমের বান্দা ! এ অসম্ভব। আমি এ আদেশ অমান্য করলাম। আপনার সমস্ত দন্ড নিতে আমি প্রস্তুত। এ উন্মাদনা থেকে, এ খেলা থেকে আপনি শান্ত হোন।
– উন্মাদনা ? এ শুধুমাত্র উন্মাদনা নয়, খেলা নয়। যন্ত্রণা। আমার আমিকে আড়াল করার বড় যন্ত্রণা। আমার প্রেম।
– যাহাপনা আপনি শান্ত হোন। ভারতের বাদশাহের এ প্রেম দুঃস্বপ্ন। আপনি ভুলে যান। ভুলে যান সবটুকু।
– কি করে বাবরি ? কি করে ? এ যে আমার খেলা নয়। আমি হারিয়ে দিতে পারি সব সুলতানদের, আমি জয় করতে পারি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। কিন্তু নিজের কাছে ওই আরশির কাছে হেরে যাচ্ছি আমি। আমারও রক্তক্ষরণ হয়, বাবরি।
– এ রক্তক্ষরণ সত্য নয়। ছাড়ুন আমার হাত, আমার নিকট হতে দূরে সরে যান, আমায় দন্ড দিন। আমি প্রস্তুত জাহাপনা। ভারতের বাদশাহের এ ভিক্ষা মানায় না।
– প্রেমের জন্য আমি জাহান্নামে যেতে পারি। আমি এই ভারি আভরণের অন্দরে আসলে একটা রক্ত মাংসের মানুষ। ভিক্ষা নয়, ক্ষিদে। আমার অন্তরের ক্ষিদে প্রিয়
– এ সর্বনাশা ক্ষিদে, হুজুর। এ আপনার বাদশাহী নিমেষ হুজুগমাত্র !
– না, না। এ হুজুগ নয়। একবার, একবার আমায় বিশ্বাস কর, আমার হৃদয়ের পংক্তি শোনো, শুনতে কি পারছ প্রিয় ?
আমার হৃদয়হরণকারী,
আমি আজ ভাবনা শক্তিহীন, আমি আজ চলচ্ছক্তিহীন
আজ আমার সর্বস্ব শুধু তোমাতে বিলীন।

– বাদশা আলম ! দরবারে বিশেষ প্রয়োজনে আজ সকলে আপনার অপেক্ষায়। জাহাপনা ! আপনি কি দরবারে উপস্থিতির জন্য প্রস্তুত ?
দরজার বাইরের এ ভারি আওয়াজে চমকে ওঠেন বাদশাহ। তবে কি এতক্ষণ নিদ্রায় ও স্বপ্নে ডুবে ছিলেন তিনি ! ধীরে ধীরে আরশির সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
কাবুলের বাজারে দেখা হওয়া সে ছেলেটির মুখ প্রতিচ্ছবিতে। দীর্ঘ সময় পরেও আজও অম্লান। আয়েশার প্রতি অন্যায় জেনেও তিনি সে ভালোবাসায় অক্ষম ছিলেন চিরদিন। চির লাজুক তিনি কখনো কথা বলতে পারেননি, সাহস জোটাতে পারেননি তাঁর মনের মানুষের কাছে তাঁর প্রেমের কথা বলবার, দূর থেকে দেখতেন – সে আছে, সে আজও আছে তাঁর হৃদয়ে … তাঁর বাবরি – তিনি লিখবেন তার কথা, বাদশাহের অন্তরের গোপন সুখের কথা … সিদ্ধান্তে অটল হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন বাদশাহ দরবারের দিকে।

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

1 Response to চন্দ্রাণী বসু

  1. Manasi Ganguli বলেছেন:

    বাহ্ খুব সুন্দর

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s