নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

ভাঙ্গা বসন্ত

“এই উদলা বডি দ্যাখানো ড্রেস তোর বোন পরবে?” মদন ভাদু কে জিজ্ঞাসা করে। ভাদু লজ্জা লজ্জা মুখ করে মাটির দিকে তাকায় আর বলে “তোমার অত দরকার কি বলো দেখি? দাও না… যা চাইছ তাই তো দিচ্ছি”। বুক দেখানো ,পেট খোলা পুরোনো সিনেমার বাইজীদের পোশাকের আদলের পোশাক। এ অঞ্চলে কেউ পরে না। দোকানে খুব আধুনিক পোশাকের সম্ভার আছে সেটা বোঝানোর জন্যে এটা টাঙ্গানো আছে। পোশাকটা দোকানের ম্যানিকুইনের গায়ে ঝুলছে। মদনের রেডিমেট পোশাকের দোকানে ভাদু মদন কে সাহায্য করে। ভাদু সকালে এসে দোকান খোলে। ম্যানিকুইন গুলো বাইরে বার করে। দোকান পরিস্কার করে। ধুপকাঠি জ্বেলে গনেশ ঠাকুর কে নমো করে। মদন গাল মন্দ করে কিছু বললে চুপ করে শোনে আর নির্বোধের মতো হাসে। ভাদুর বাড়িতে কে আছে, আগে কোথায় বাড়ি ছিল, মদন ওসব জানতে চায় না কোন দিন। আজ ভাদুর বোনের কথা জেনে অবাক হল।ভাদুর পরিবার যে খুব ‘বাজে’ টাইপের সেটা বুঝতে মদনের বাকী রইল না।নিজের স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে আধময়লা সুপার ম্যানের ছবি লাগানো শার্ট পরে নেয় ভাদু,এবার বাড়ি যাবে ।ভাদু ম্যানিকুইনের গা থেকে পোশাক খুলে ভালো করে বার করে প্যাক করে নিল। মদনের আচমকা মনে পড়ল ভাদু প্রথম যখন এসেছিল তখন একবার মেল ম্যানিকুইন কে একটা লেহেংগা চোলী পরিয়ে বাইরে দাঁড় করে দিয়েছিল। আসেপাশের দোকানদার রা খুব হেসেছিল। থুতনিতে দাড়ি মেল ম্যানিকুইনের গায়ে লাল চোলী।ঘা কতক চড় থাপ্পড় খেয়েছিল সেদিন ভাদু। চোখের জল মুছেছিল মার খেয়ে। তারপর আর ভুল করেনি।

ওমপ্রকাশ জানে ওর মেয়েটা ওর ‘সন্তান’ নয়। কিন্তু মেয়ে কে খুব ভালোবাসে। পাড়ার কলতলায় প্রতিবেশিনী জমায়েত হয়ে ওমপ্রকাশের বউ কে খুব হিংসা করে। ওমপ্রকাশ তাঁর সব টাকা পয়সা বউয়ের হাতে এনে দেয়। কোনদিন ওর বউয়ের গায়ে হাত তোলে না। রান্না খারাপ হলে কিছু বলে না।কিন্তু বউ ওমপ্রকাশ কে মোটেও পাত্তা দেয় না। ঝগড়া ঝাঁটি করে না কিন্তু ‘এসো গো’ ‘বস গো’ ‘খাও গো’ করে না। ঠাণ্ডা সম্পর্ক কিন্তু সাথে থাকে। মেয়েটা ভালো মানুষ হচ্ছে। ওম প্রকাশের আজ খুব আনন্দ। একটা স্মার্ট ফোন কিনেছে। এই ফোনটা তার লুকানো টাকা থেকে কেনা,লুকানো সম্পত্তি। বউ কে দুমাস পর আরও ভালো একটা কিনে দেবে ।কিন্তু এটার কথা জানাবে না।বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সে ফোনে গান শোনে।সেই গান টা।রেখা গাইছে, ‘ দিল চিজ ক্যায়া হ্যাঁয় আপ মেরে…’চোখে জল এসে যায়। ভাদুর জন্যে বুক হু হু করে ওমপ্রকাশের। ভাদু প্রথম নিয়ে গিয়ে ছিল নলহাটির সিনেমা হলে দুজনে গা ঘেঁসে বসে দেখেছিল। রাতে বাড়ি ফিরবার পথে চাঁদের আলো আর কোকিলের ডাক।

“ভাদু তোর হোয়াটস আপ আছে?” ফোন করে প্রথম জিজ্ঞাসা করল ওমপ্রকাশ।হেসে গড়িয়ে পরে ভাদু উত্তর দেয়,“সেই জন্নি তো তোরে ইস্মারট ফোন কিনতি বললাম।” ভিডিও কল করে ভাদু।বহুকাল পরে ফোনে সামনা সামনি হয় দুটো আধ ভাঙ্গা মানুষ। একসাথে থাকলে হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সম্পর্ক হত তাদের। দুজনায় প্রথম দফায় কেবল হাসল।তারপর ওমপ্রকাশের চোখে জল আসে। ভাদু ওদিক থেকে বলে ‘কেঁদো না’। শেষ হয়ে যায় কথা। অনেক কথা বলা হয় না।

নিজের ঘরে ঢোকে ভাদু। ভাদুর একার ঘুপরি।পরিবার ভাদু কে চায় না। ভাদু একা থাকে। ঘরে অনেকগুলি ঠাকুরের ছবি। ঘরের মধ্যে খানে দাঁড়ায় ভাদু। বেশ অনেকটা জায়গা তো। হাত পা নাড়ানো যাবে। ভালো করে চুল আঁচড়ায়। মুখে ক্রিম মাখে। হাতে চুড়ি পরে। চোখে ঘন করে কাজল। আজ সে রেখা হবে। মদনের দোকান থেকে নিয়ে আসা সেই বাইজী পোশাক পরে নেয় ভাদু।

ওমপ্রকাশের বউ বিরক্ত হয়ে যায়।এতোক্ষন কি কেউ পায়খানায় ঢুকে থাকে। মিনসেটা কে ইসবগুল গেলাতে হবে দেখছি।ওমপ্রকাশ তার এক চিলতে নিভৃতির মধ্যে আজ নাচ দেখবে। তার নিজের ‘রেখা’র। একমাত্র তার জন্যে নাচবে আজ ‘রেখা’। ভাদুর নাভির নীচে ঝিলমিলে লেহেঙ্গা। বুকে ব্রেসিয়ারের মত চোলী।খসখসে শরীর জুড়ে অদক্ষ নাচের চেষ্টা। স্মার্ট ফোনের দিকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে ওমপ্রকাশ।‘দিল চিজ ক্যায়া হ্যাঁয় আপ মেরে…।’ বাইরে আমড়া গাছে খুব কোকিল ডাকছে।

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

2 Responses to নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

  1. অজ্ঞাত বলেছেন:

    বাহ্ খুব ভাল লাগল

  2. Manasi Ganguli বলেছেন:

    সুন্দর গল্প

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s