ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

রামধনু রং প্রেম

আমাদের হিজড়ে বলল আর তুই চুপ করে রইলি?
কেন সেদিনও ছক্কা বলল তো। ওসব বাদ দে।
শমিতা আর তিস্তার ফেসবুকের এক অপরিচিত বন্ধু এমন ওপেন কমেন্ট করেছে এভাবে।
ফেসবুকেই আলাপ ওদের । বছর দুয়েকের ডিজিটাল ঘনিষ্ঠতা রিয়েল প্রেমে পূর্ণতা পেতে না পেতেই মন্তব্যের ঝড়।
এখন শমিতা আর তিস্তা ফেসবুক পেজ থেকে “এলজিবিটিকিউপ্লাস” দের কর্মকাণ্ডে সামিল হয় ।
ছক্কা, হিজড়ে শুনে শমিতার মা বলল, এতে এত রাগের কি আছে? দুজন মেয়ে বা দুজন ছেলে এত কাছাকাছি এলে লোকে এমন বলবেই আমাদের সমাজে।
– এখনো কিসের সংশয় মা তোমাদের? সামাজিক বিয়ে নাহয় করব না কিন্তু আমাদের লিভ ইন করার অনুমতিটা অন্তত দাও প্লিজ। শমিতা বলেছিল মাকে।

– আজকাল কাগজে পড়ছনা? সমকামিতা বৈধ। দুটি মেয়ে বা দুজন ছেলের মধ্যে বিয়ে এখন আকচার হচ্ছে । তুমি আমাদের প্রেম কে মানোনা?
– হু! প্রেম! সমকামী বিয়েটা ঠিকঠাক আইনতঃ এখনো বৈধ নয় আমাদের দেশে, তবুও তোরা…বিরক্তিতে মায়ের ওপর প্রচ্ছন্ন ঘৃণা এসেছে শমিতার ।

তিস্তার মা বাবার নেমরাজি কিন্তু আপত্তি এই থাকাথাকিতে। পাকাপাকি পার্টনারশিপে।

শমিতা আর তিস্তা একে অপরকে পাগলের মত ভালোবাসে। মেট্রোরেলের কামরায় দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে প্রকাশ্যে চুমু খেয়েছে আর তার জেরে ট্রোল্ড। ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শেষমেশ বেধড়ক পিটুনি। অশ্রাব্য গালিগালাজে ওরা নাকাল সেদিন।
তাই বলে গায়ে হাত তুলবে? একে অপরের বিধ্বস্ত ছবি তুলে ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপের এলজিবিটিকিউপ্লাস গ্রুপে পোস্ট করায় ভাইরাল হল সে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সেদিন শমিতা বাড়ি ফিরতেই বাবা বললেন,
– আর পারা যাচ্ছেনা তোমাদের নিয়ে। নিজেদের সংযত কর একটু। প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটানোর কোনো মানে হয়? কাল বাজারে গিয়ে মুখ দেখাব কি করে? কি প্রয়োজন‌ই বা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ঐ ঘটনার বিশদ বিবরণ দিয়ে পোস্ট দেবার?
শমিতা বলেছিল,
– বাবা তুমিও?
বেশ তো, এবার ঠ্যালা সামলাও। কত শখ ছিল আমার! একটা মাত্তর মেয়ের ঘটা করে বিয়ে দেব। আমার বিয়ের চন্দ্রহার, কানবালা মেয়ের বিয়ের জন্য তুলে রেখেছিলাম। আমার সব ইচ্ছেয় এক ঘড়া জল ঢেলে দিলি তুই?
ভালোই তো মা। তিস্তা কে সাজিও তোমার গয়না দিয়ে।

– কি বললি তুই? একটা হিজড়ে ও। সেদিন ফেসবুকে কি বলল সেই মেয়েটা?
তুই বড় বেশি বুঝে গেছিস। বিয়ে থা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।

– কি ঠিক হবে মা? জীবনে যদি বিয়ে করি তো তিস্তাকেই করব। তোমরা এই কেমিস্ট্রি জীবনেও বুঝতে পারবে না। শমিতাও বেশ ঝাঁঝালো উত্তর দেয়।
– যাই বলিস তুই, তিস্তা মেয়ে নয়। তাহলে তোর প্রতি ক্রাশ হতনা ওর।

শমিতা বলে উঠল,
– ছোটবেলায় সব বন্ধুদের যখন অ্যাডলেসেন্স এ ক্লাসের বন্ধুদের বুক উঠছে সবেমাত্র। আমারও বুকে ব্যাথা ছিলনা। তুমি এড়িয়ে যেতে ।
প্রথম পিরিয়ডস হতে আমার মন খারাপ হয়েছিল খুব। তুমি খুব শান্তি পেয়েছিলে যেন। আবার সেই পিরিয়ডস ইরেগুলার হতেও ডাক্তার দেখিয়েছিলে মনে আছে ? উনি তোমায় হরমোনের ফান্ডা দিয়েছিলেন। তুমি তখনও চুপ । প্রকৃতির নিয়ম কে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলে। প্রচুর টেস্ট করে ডাক্তার বলেছিলেন আমি স্বাভাবিক মেয়েদের মত নই।
মা কেঁদে ফেললেন।
সেদিনও তুমি বাড়ি এসে খুব কেঁদেছিলে মা। কি করি বলত আমি? স্বাভাবিক মেয়ের জন্ম দাওনি শুনে বাবা সেদিন তোমায় পুরাণের ফান্ডা দিয়েছিল বিস্তর। মনে পড়ে মা? তুমি বলেছিলে চুলোয় যাক অর্ধনারীশ্বর, হরিহর, ইরাবানের গল্প। আমার পেটে এমন সন্তান হল? কি পাপ করেছিলাম আমি?
মা বললেন, তুই চুপ করবি?

সেদিনের বাকবিতণ্ডার পর পাড়ার স্টল থেকে শমিতা কিনে এনেছিল “রূপ” ম্যাগাজিনটি। সরকারি অনুদানে সদ্য প্রকাশিত এলজিবিটিকিউপ্লাসদের নিজস্ব ম্যাগাজিন।

শমিতার মায়ের চোখের সামনে তখন রূপ ম্যাগাজিনের চকচকে রঙিন খোলা পাতায় শমিতা এবং তিস্তার ছবি। সে পাতায় শুধুই রামধনুর সাত রং। ওদের লিভ ইন রিলেশনশিপের খবর বেরিয়েছে সেখানে। তাদের মেয়ের এখন নাম শমী। যাকে তিস্তা মনেপ্রাণে পার্টনার বলে মানে।

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

2 Responses to ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

  1. অজ্ঞাত বলেছেন:

    ভালো লাগলো দিদি।কিন্তু পিরিওড হবার পরেও যে এমন সমস্যা হয় তা জানতাম না।

  2. Manasi Ganguli বলেছেন:

    খুব ভাল লাগল

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s