শুভশ্রী সাহা

বিশ্বাসঘাতক

রাত নিশুত হলে জলমহলের একটি কক্ষে আলোর রোশনাই লেগে যায়। দিল্লী আগ্রা শাহি সড়ক থেকে হ্রদের ছায়ায় সেই আলো দেখা যায় রাত ভোর। আখেনগারের বাতিগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ে ভোর না হতেই। দেওয়াল জোড়া মস্ত ইংলিশ্চানি আরশীতে ছায়া পড়েরেশমী জরির দোপাট্টা, রক্ত রাঙা কাঁচুলি আর ঘাগরার জৌলুস। আরশীতে মুখ দেখছেন শাহি আলি কুলি খান, নারাউলের মনসবদার, বৈরাম খাঁর সার্থক বংশধর দুদ্ধর্ষ লড়াকু মুঘল জাঁবাজ সেনাপতি।
কিন্তু তার চোখে এখন মোটা কাজল, ঠোঁটে রঙ, কপালে মাঙটীকা
গলায় মুক্তোর হার হাতে বালা চুড়ি,দুই চোখ সিরাজের নেশার থেকেও শক্ত আবেশে ঢুলুঢুলু। তিনি এখন কারুর প্রেয়সী! কিন্তু কই! তার সেই বহু প্রতীক্ষিত প্রেমিক! যার জন্য আসলে তিনি প্রায় উন্মাদ হতে বসেছেন, তার এই লুকোনো নারীস্বত্ত্বা ধন্য! তার প্রভু শাহিম বেগ!

— হুঁজুর—–, সিপাহীশালার শাহিম বেগ এসে পৌছেছেন প্রাসাদে, ফিসফিস করলে খাস তদারিকদার মোবারক খাঁ। অনেক আগে মোবারক খাঁও এক আধবার প্রভুর শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে বইকি!

— তমিজ সে পেশ করো! পেছন ফিরলেন না হুঁজুরে আলা

— আমার রাজা, আমার প্রাণ, কবুল করুন আমার মোহাব্বতকে! আপনার পায়ের নিচে সারা হিন্দুস্থান নজরানা দেব মেরে হুঁজুর!
শুয়ে পড়লেন জাঁবাজ লড়াকু আলি কুলি খান, তার প্রেমিক শাহিম বেগের পায়ের তলায়!
— একি করছেন, আপনি প্রভু, আমি এক সাধারণ সিপাহীশালার, বিগত এক বর্ষকাল একথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত প্রভু।আমি আপনার দাস মাত্র!
— মুখ তুলনেন আলি কুলি খান, এগিয়ে এলেন শাহিম বেগের কোলের উপর। শাহিম মুখ নিচু করে তুলতে যেতেই জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। আতরের সুগন্ধ, গুগগুলের সুবাস, মেহেন্দীর খুশবু মিশিয়ে এলো শাহিম বেগের নাকে। চুম্বন করলেন আলিকুলি , তার প্রেমিক কে। মুহূর্তে ছিটকে গেলেন শাহিম বেগ!

ইনশায়াল্লাহ! রেহেম করো, তুমি চাইলে আমি তোমাকেও দশহাজারী মনসবদারী দিতে পারি। আমি বৈরাম খানের ভাই!
তুমি আমি কত সন্ধ্যা কাটিয়েছি, এই জল মহলে। বিলোচপুরের তাঁবুতে তুমি আমায় স্বর্গীয় তৃপ্তি দিয়েছ প্রিয়তম! আহ তুমি কি সুপুরষ, সুগঠিত, মেরে হুজুর,আমায় গ্রহণ করো, সেই তৃপ্তি দাও। মখমলের জারদৌসির সতরঞ্চিতে শুয়ে পড়লেন আলি কুলি খান! ছটফট করছেন! তার রেশমী ওড়না, জরিদার কাঁচুলি খুলে খুলে যায়,তার শরীর এখন পুরুষ খুঁজছে!

হুঁজুরে আলা,আমি একজন কে মো্হাব্বত করি!, বেশক আমরা নিকা কবুল করতে চাই আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন!

সপাটে চড় পড়ল শাহিম বেগের গালে। কে সে! এক্ষুনি বল খুন করব তাকে! কাঁপছে আলি খুলি খান! তার দু চোখে আগুন ঝরছে! মোহাব্বত! তাহলে আমি কে!

আপনার বড়েভাই বৈরাম খানের মেয়ে নাফিসা!

নাফিসা! নাজুক কবুতরী! তারই কোলে পিঠে করে মানুষ।
ভুলে গেছিস, খোরাসানের বাজার থেকে তোকে কে স্থান দিয়েছিল হিন্দুস্থানের আবাদিতে! আর কে বানিয়েছে তোকে সিপাহীশালার! বিশ্বাসঘাতক! বেরেহম!

শাহিম কে সে খুনীর চোখে দেখল,তার পিঠ পিছে এই ভাবে তার শান্তি সুখ জীবন নষ্ট করে দিল! নাফিসা তার প্রাণ! শাহিম নষ্ট করবে ওকে, ওর নোংরা হাতে স্পর্শ করে! সে দিনের পর দিন একা রক্তাক্ত হবে! কবে থেকে সে এই সুপুরুষ যুবকটির
প্রেম ভিখারিনী! জানত না শাহিম বেগ! সারা জল মহল সাক্ষী! আখেনগারের আলো আজ নিভে আসছে বড় তাড়াতাড়ি!
চোখ তুলল আলি কুলি খান, চোখে আগুন, আগুন ঘেরা টলটলে পুকুর!
–এ কথা আর কে কে জানে!
–কেউ না হুজুর, নাফিসা ছাড়া!
নিমেষে কষিতে গোঁজা ছুরিকা ছুড়ল শাহিম বেগের দিকে!
মৃত শরীর টা এক ঝটকায় তুলে নিয়ে ফেলে দিল জলমহলের হ্রদের জলে।

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

1 Response to শুভশ্রী সাহা

  1. Manasi Ganguli বলেছেন:

    খুব সুন্দর

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s