নীতা রায়

মেথি গন্ধ

আবার হাঁফাতে হাঁফাতে এল টুসি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
– শেতলমা, শেতলমা, তাড়াতাড়ি চলো।
আগেও এভাবেই ডেকেছে।
শেতলমণি ওঠে নি। আঁচারের জন্য ভাজা মশলা গুঁড়ো করতে বসেছে। মুরমুরে ভাজা অবস্থায় গুঁড়ো না করলে, আর ঠিক মতো তাক হবে না। মাপ চাই ঠিক ঠাক। ভাজা হলুদ গুঁড়ো হয়েছে। ধনে ভাজা গুঁড়ো হয়েছে। এখন মেথি ভাজার গন্ধে ঘর ভরে আছে।
হামানদিস্তা র খট্ খট্ আওয়াজ থামিয়ে দিল শেতলমণি।
– আমার টুসিমা কে ঠাকুমা বুঝি লুচি ভেজে দেয় নি?
একটু টেনে টেনে, সোহাগ ঢেলে, কথাগুলো বলল শেতলমণি ।
– লুচি ভাজবে কি করে? ঝগড়া হচ্ছে যে!
চোখ ভ্রূ কুঁচকে উত্তর দিল টুসি।
টুসির কথা শুনে কিছুটা অবাক হল শেতল।

আজ পূর্ণিমা। নিরামিষ রান্না ।ছোট জা অদিতি একা সামলে নিতে পারবে বলেই আঁচার বানানোর কথা ভেবেছে সে। জলখাবার এর দায়িত্ব নিয়েছেন শাশুড়ি মা। তাহলে, ঝগড়া হচ্ছে কেন?
টুসি এখনও যায় নি। দাঁড়িয়েই আছে দরজায়।
শেতলমা উঠছে না দেখে বলতে লাগল টুসি,
– বড় পিসেমশায় এসেছে । জানো তো! ঠাকুরদাদু, বড় পিসেমশায়, আরো কত জন! সবাই মিলেই তো ঝগড়া করছে। বার বার, শেতলমণি, শেতলমণি, বলে বলে ঝগড়া করছে! পৃথাদিদির বিয়ে হচ্ছে না যে! তাই জন্যই ঝগড়া করছে।
একটানা কথাগুলো বলে থামল টুসি।
তারপর, একটা পা ঘরের মধ্যে রেখে, আদর চেয়ে বলল, – আমি তোমাকে ছোঁব শেতলমা? একটু – – খানি? শুধু কথার সুরে নয়, তার ছোট্ট হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এবং তর্জনী জোড়া না লাগিয়ে, সামান্য ফাঁক রেখে, ‘একটুখানি’ বুঝিয়ে দিল।

শেতলমণির স্বভাব ধীর, স্থির। দীর্ঘ ষোল বছরের বিবাহিত জীবন তার। যদিও তার এই জীবনকে বিবাহিত জীবন বলা যায় কি না, সে জানে না। মানে শুধু নিজের মনে।
সেই অর্থে সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান তো হয় নি!তারও তো স্বপ্ন ছিল অনেক। তাগিদ ছিল সেই স্বপ্নকে রূপ দেওয়ার। কিন্তু, বলবে কাকে? যাবে কোথায়? সে তো পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে। অথচ, নিজের মনে মনে সে নারী। স্কুলে যায়। ক্লাসের ছেলেরা তাকে এড়িয়ে চলে। মেয়েরা তাকে বিশ্বাস করতে চায় না।

হঠাৎ একটা দিন। মণিবাবু, এই ঘোষবাড়ির বড় ছেলে মণিকান্ত ঘোষ, নিজেই ডেকেছিল তাকে। গ্রামের হাটতলায়, মণিবাবুর দশকর্মা ভাণ্ডারে কাজে লেগেছিল শেতল। দশকর্মার হাজারো জিনিসের হিসাব রাখত সে। সেই দুজনের সম্পর্কের শুরু।স্বপ্ন দেখার শুরু।

তখনও শাড়ির মত করে ধুতি পরত শেতল। গায়ে থাকত রঙিন ফতুয়া। এখন অবশ্য ফতুয়ার রঙ সাদা। ফতুয়ার উপর দিয়ে আঁচল টানার মত জড়িয়ে রাখে ধুতির প্রান্ত। লম্বা চুল, বড় খোঁপা হয়ে থাকে তার টানটান ঘাড়ের উপর।

মণিবাবু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তাকে এই বাড়িতে। গিরিচন্দন দিয়ে সাজিয়ে। কোর্টে এফিডেবিট করে, শেতল দাস হয়েছিল শেতলমণি ঘোষ ।
সে তো বহু বছর আগে। অদিতির কোলে তখন এক বছরের শিশু কন্যা, হাসি।
এই বাড়ির কেউ কোনও কথা তোলে নি। চাষী বাড়ি। কাজের লোক কিছু কম নয়। সবাই যেন জেনে গিয়েছিল, এমনটাই হতে চলেছে। যেন অবধারিত ছিল সব কিছু।
বিস্ময় জেগেছিল বই কি! তার জীবন তো সহজ ভাবে এগোয় নি কখনও। এই বাড়ির সকলে মেনে নেওয়ার পরেও এই বড় নন্দাই এসেছিল, বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। শেতলমণি কে অপমান করতে।
কথাটা মনে পড়তেই, ছিঃ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল শেতলমণি। রঙিন সব স্বপ্নের রঙ এখন একত্রে মিশে গিয়ে সাদা হয়ে গেছে।
তবু, মনের কোনো এক কোণ থেকে এক একটা রঙ ভেসে ভেসে আসে। উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। আবার সাদা হয়ে যায়।
এখন হিসাব করে দেখতে ইচ্ছা হয়, কোন রঙ কতক্ষণ বেঁচে থাকে তার মনে।

সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামছিল শেতলমণি।
ধারালো অস্ত্র হাতে বসে আছে বিরোধী পক্ষ। এক নিরস্ত্র সেনা নেমেই চলেছে, তাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।সারা শরীরে তার মেথির গন্ধ। পরিমাণ বুঝে যার কদর। বেশি হলেই তিক্ততা।
হাতের মুঠো শক্ত করে এগিয়ে চলল শেতলমণি।

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s