ইন্দিরা মুখার্জি

নামদুর্গা

এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহুনাম্মী আমাদের মা দুর্গা । দুর্গার নামের বৈচিত্র্য হল এবারের নিবন্ধের বিষয়বস্তু।  শিবঘরণী, শিবসোহাগীনি দুর্গা হিমালয় পর্বতের কন্যা বলে তাঁর এক নাম পার্বতী। তিনি বিশ্বচরাচরের অন্নদায়িনী তাই অন্নপূর্ণা, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। স্যার ফ্রেজার তাঁর  Adonis গ্রন্থে  প্রাচ্যের এক বৃষভবাহন দেবতা ও সিংহবাহিনীদেবীর উল্লেখ করেছেন। তিনি শিব বা দুর্গার নাম উল্লেখ করেননি কিন্তু তারাই যে আদতে আমাদের হর-গৌরী তা একেবারে সুস্পষ্ট। A short history of religion গ্রন্থে কেলেট সাহেব মুক্তকন্ঠে প্রকাশ করেছেন শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবতা সর্বপ্রথম প্রাচ্যেই বিকাশ লাভ করেছিলেন। তাঁর ব‌ইতে বোনদিয়া (Bona Dea) নামক এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি a deity of fertility বলে প্রচলিত এবং এই বোনদিয়া আমাদের সুন্দরবনের বনদুর্গা বা বনবিবি যিনি আমাদের শাকম্ভরী দুর্গা সে কথা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধা হয়না ।  এই শাকম্ভরী হল মাদুর্গার অনেকগুলি নামের মধ্যে অন্যতম।
শরতঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবাণী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চন্ডী  এইসব নামগুলি বাংলাদেশেই প্রচলিত। নেপালে দেবী নবরাত্র, কাশ্মীরে অম্বা, গুর্জরে হিঙ্গলা বা রুদ্রাণী, কনৌজে কল্যাণী, দাক্ষিণাত্যে অম্বিকা , মিথিলায় ঊমা নামে তিনি পূজিতা ।  এছাড়া বাংলাদেশের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মাটির বুকে শক্তির আরাধ্যারূপে পূজিতা দেবী শীতলা, মনসা, বাশুলি, ষষ্ঠী, মঙ্গলচন্ডী সকলেই মা দুর্গার অংশ বিশেষ। শ্রীশ্রীচন্ডীর একাদশ অধ্যায়ে আছে অনাবৃষ্টির সঙ্কটে পৃথিবী যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তখন ঋষিদের স্তবে তুষ্ট হয়ে শক্তিময়ী দেবী নিজের দেহ থেকে উত্পন্ন শাকসব্জীর দ্বারা বিশ্ববাসীর প্রতিপালনে সচেষ্ট হন। সেই শাক ভক্ষণ করে মানুষ প্রাণ ফিরে পায়। ইনিই দেবী শাকম্ভরী।  যতদিন না পর্যন্ত বৃষ্টি হয় ততদিন সমগ্র বিশ্বের মানুষকে দেবী নয়রকম শাক খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাই এই শাকম্ভরী ই শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, চন্ডী, কালিকেশা ও পার্বতী নামে বিদিতা। রাজস্থানের কাছে আজমীরে শাকম্ভরী তীর্থে এই কাহিনী বর্ণিত আছে। শ্যামল সবুজবর্ণ শাকসব্জীর রঙে ভূষিতা বলেই দেবী শাকম্ভরী নীলোত্পল বর্ণা। পশ্চিমবাংলার কাটোয়া থেকে আট মাইল দূরে মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত মাজিগ্রামে শাকম্ভরী দেবীর পুজো হয়।
ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র শারদীয়া দুর্গাপূজার  প্রচলন করেন  । রাবণবধ ও সীতাউদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র দুর্গতিনাশিনী দুর্গার অকালবোধন করে নবরাত্র ব্রত পালন করেছিলেন। নবরাত্র ব্রত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত । মা দুর্গা এই সময় অর্থাত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথি থেকে নবমী অবধি মোট ন’দিন নয়টি রূপ ধারণ করেন। পিতামহ ব্রহ্মা দেবীর এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন। নয়টি নামের নয়টি বৈচিত্রময় রূপভেদ। এঁরা প্রত্যেকেই দেবীর নয়টি কায়াব্যূহ মূর্তি। নবদুর্গা নামে এঁরা বিশেষ পরিচিত। শ্রীশ্রী চন্ডীতে এই নয়টি নামের উল্লেখ আছে। নবদুর্গার এই নয়টি নাম হল
শৈলপুত্রী ( পর্বতের কন্যা)
ব্রহ্মচারিণী (যিনি ব্রহ্মাকে স্বয়ং জ্ঞান দান করেন)
চন্দ্রঘন্টা ( দেবীদুর্গার মহিষাসুর বধের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের প্রদত্ত ঘন্টা যার মধ্যে গজরাজ ঐরাবতের মহাশক্তি নিহিত ছিল )
কুষ্মান্ডা ( উষ্মার অর্থ তাপ । দুর্বিষহ ত্রিতাপ হল কুষ্মা। আর যিনি এই ত্রিতাপ নিজের উদরে বা অন্ডে ধারণ করেন )
স্কন্দমাতা ( দেব সেনাপতি কার্তিকেয় বা স্কন্দের মা)
কাত্যায়নী ( বৃন্দাবনে দেবী গোপবালা রূপে পূজিতা। ব্রজের গোপবালারা এই কাত্যায়নীর কাছে প্রার্থণা করেছিলেন নন্দের নন্দন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য তাই ব্রজের দুর্গার নাম কাত্যায়নী)  কালরাত্রি(ঋগ্বেদের রাত্রিসুক্তে পরমাত্মাই রাত্রিদেবী। প্রলয়কালে এই রাত্রিরূপিণী মাতার কোলেই বিলয় হয় বিশ্বের। দেবী যোগনিদ্রা মহাকালিকা বা কালরাত্রি নামে আখ্যাত)
মহাগৌরী (তিনি সন্তানবত্সলা, শিবসোহাগিনী, বিদ্যুদ্বর্ণা  মা দুর্গার প্রসন্ন মূর্তি) এবং
সিদ্ধিদাত্রী ( যিনি প্রাতঃসূর্যের মত রঞ্জিতা যোগমায়া মাহেশ্বরী , সকল কাজে সিদ্ধি প্রদান করেন )
সতী, পার্বতী, ঊমা এবং গৌরী দুর্গার এই চারটি রূপ হল শিবের পত্নী রূপ। তাই শিবাণী, রুদ্রাণী, অদ্রিজা,  এই নামগুলি হল আমাদের মনগড়া এবং বাংলাসহিত্যের অভিধানে বর্ণিত মাদুর্গার নামান্তর মাত্র। দক্ষযজ্ঞের প্রলয়ের কারণে  দক্ষকন্যা সতীর অপর নাম দাক্ষায়নী। এবার বেদের সপ্তমাতৃকায় আসি। দুর্গার এই সপ্তমাতৃকার নামগুলি হল ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী ইন্দ্রাণী বা ঐন্দ্রী বা কৌমারী, নারসিংহী, বারাহী এবং চন্ডী  ।  এই মহাশক্তিময়ী দেবীরা অগ্নিরূপী শিবের বা সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রী শ্রী চন্ডীতে দেবীকবচে একাদশ মাতৃকার উল্লেখ আছে। এই একাদশ মাতৃকা পূর্বে উল্লিখিত  নবদুর্গা ও সপ্তদুর্গার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।
ঘুরেফিরে সব রূপগুলিতেই সর্বকালে চামুন্ডা শবাসনা, বারাহী মহিষারূঢ়া, ইন্দ্রাণী গজাসনা, বৈষ্ণবী গরুড়াসনা ও  মহাবীর্যা নারসিংহী, মহাবলা শিবদূতি, বৃষাঢ়া মাহেশ্বরী, শিখিবাহনা কৌমারী , পদ্মাসনা লক্ষ্মী, বৃষবাহনা ঈশ্বরী, হংসারূঢ়া ব্রাহ্মী এবং এঁরা সকলেই একাদশ মাতৃকার বৈচিত্রময়ী রূপ।  দুর্গার এই নামগুলি ছাড়াও শ্রীশ্রীচন্ডীতে মহালক্ষ্মী, মহামায়া, মহাবিদ্যা, মহাবাণী, ভারতী, বাক্‌ সরস্বতী, আর্যা, ব্রাহ্মী, কামধেনু, বেদগর্ভা, ধীশ্বরী, সুরেশ্বরী, দেবেশী, অশোকা, বিপদতারিণী, শতাক্ষী প্রভৃতি অগণিত নামের উল্লেখ আছে। এছাড়া দুর্গাপূজার পর বিজয়াদশমীতে এ অপরাজিতা পূজা হয় সেই অপরাজিতা এবং দুর্গা এক ও অভিন্ন। এই অপরাজিতা দেবী দুর্গার চৌষট্টি যোগিনীদের মধ্যে অন্যতমা। এমনকি জগদ্ধাত্রী পুজোতেও নবশক্তির অর্চনারপর দেবতাদের পুজোর মধ্যেও “অপরাজিতায়ৈঃ” মন্ত্রে দেবীপূজা করা হয়। মত্স্যপুরাণে এই অপরাজিতাকে মায়ানুচরী বলা হয়েছে। বামনপুরাণে ইনি গৌতম মুনি ও অহল্যার চারকন্যা জয়া, বিজয়া, জয়ন্তী ও অপরাজিতা। সেখানে আবার এই চারভগ্নী শিবজায়া সতীর সহচরী সখী রূপে অভিহিত। দেবী অপরাজিতা প্রণাম মন্ত্রে রুদ্রলতা নাম পাওয়া যায়। তাই তিনিই যে শিবসঙ্গিনী দুর্গা সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই ।
দেবীপুরাণে দেবীর আরো নানাবিধ নামের উল্লেখ আছে। দেবী দুর্গার সন্ধিপূজায় দেবীর চামুন্ডারূপের পূজা হয়। দেবর্ষি নারদ সেখানে দেবীকে অর্চণা করছেন নিম্নলিখিত নাম ধরে। দুর্গা, শাকম্ভরী, গৌরী ছাড়াও বিন্ধ্যবাসিনী, কাত্যায়নী, কৌষিকী, কৈটবেশ্বরী, মহাদেবী, মহাশ্বেতা, মহেশ্বরী, ত্রিদশবন্দিনী, ঈশানী, ভবানী, ভূতভবানী, জ্যেষ্ঠ্যা, ব্রহ্মবাদিনী, অপর্ণা, কপালা, সুবর্ণা, গায়ত্রী, সাবিত্রী, ত্রিশূলিনী, ত্রিনয়না, ত্রিপদা, ত্রিগুণাত্মিকা, শ্রদ্ধা, স্বাহা, সর্বজ্ঞা, সর্বতোভদ্রা, সর্বোতক্ষী, সর্বভূতাদিমধ্যান্তা, সর্বলোকেশস্বরূপা, কামরূপিণী, যাদবী, যোগীন্দ্রা, বৈষ্ণবী, অরূপা, ভদ্রকালী, স্কন্দমাতা, শ্রুতি, স্মৃতি, কালরাত্রি, মহারাত্রি, কপালিনী, চামুন্ডা, চন্দ্রিকা, চন্ডী, চন্ডমুন্ডবিনাশিনী, রুদ্রাণী, পার্বতী, ইন্দ্রাণী, দাক্ষায়নী, নারী, নারায়নী, শুম্ভ-নিশুম্ভ দলনী, মহিষাসুরমর্দিণী, সহস্রলোচনা, ধীরা, রেবতী, সিংহবাহিনী, বিশ্ববতী, বেদমাতা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মায়াবতী, ভোগাবতী, সতী, সত্যবতী, ভীমা, উগ্রা, ধূম্রা, অম্বিকা, ত্রম্ব্যকপ্রিয়া, জটা, বিজয়া, অজিতা, অপরাজিতা, পাপনাশিনী প্রভৃতি । মহিষাসুরমর্দিণী দুর্গার সবচেয়ে রুদ্ররূপ যেখানে তিনি একাধারে  দনুজদলনী আবার অন্যদিকে কল্যানী এবং বরাভয়দায়িনী। তিনি ঘোরা আবার প্রসন্না। আসলে বিশ্বমাতা মা দুর্গা এই সকল রূপের সমষ্টি মূর্তি। একই দেবী দুর্গা আবার কামেশ্বরী ও ভদ্রকালী। উভয়েই শাক্তদেবী, এক ও অভিন্না। দশমহাবিদ্যা কালীর দশটি রূপ কিন্তু তত্ত্বগত ও আদর্শগত দিক থেকে এক ও অদ্বিতীয়। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা  এই দশটি রূপ কিন্তু একাধারে কালী অন্যধারে দুর্গাকে বর্ণিত করে।

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

4 Responses to ইন্দিরা মুখার্জি

  1. Chaitali Chatterjee বলেছেন:

    tomar ei lakha ti theke onek notun kichu jante parlam.

  2. Pranab Basu Ray বলেছেন:

    ঋদ্ধ হলাম অবশ্যই…অনেকটা অজানায় ছিল

  3. yeranesar বলেছেন:

    ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানার ছিল। আমরা অনেকে অনেক কিছুই জানি না। আপনা এই পোস্টটি দ্বারা অনেকে কিছু তথ্য জানতে পারবে।আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। ছোট একটি তথ্য আপনার উপকারে আসতে পারে Residential

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s