সুবীর বোস, কোলকাতা
তখন আমাদের বাড়ির খুব কাছেই রমরম করে চলা মৃণালিনী সিনেমা হল। তখনও সিনেমা দেখার বয়েস হয়নি, কিন্তু মনে আছে, সময়-সুযোগ পেলেই হলের দেওয়ালে, কাচের বাক্সে লটকানো ছবিগুলো দেখে আসতাম। তখন সমিত ভঞ্জ বা স্বরূপ দত্ত কাউকেই আমার চেনার কথা না, তবু রাস্তাঘাটে, “তুমি তো আমার আপনজন” শুনে শুনে বুঝতে পারতাম যে একটা মারকাটারি বই এসেছে। পরে আপনজন, মেরে আপনে(হিন্দি) একাধিক বার দেখেছি। কিন্তু তাতে কী? সিনেমা দেখা, তা নিয়ে আলোচনা করা, এগুলো যৌবনে আরও অনেকের মতো আমি/আমরা অনেক করেছি। কিন্তু সে আলোচনাটা মূলত ওই ভালো সিনেমা আর তার নায়ক-নায়িকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। আলোচনায় “পরিচালক” আসতে আমার ধারণা একটা বয়েসে পৌঁছতে হয়। তো, সে বয়েসে যখন পৌঁছলাম তার অনেক আগেই কাবুলিওয়ালা, ক্ষুধিত পাষাণ, হাটে-বাজারে, ক্ষণিকের অতিথি, সাগিনা মাহাতো এবং অবশ্যই ঝিন্দের বন্দী দেখে ফেলেছি। আর হ্যাঁ, “ঝিন্দের বন্দী” আমাদের কাছে ছিল “উত্তম ভক্ত” বনাম “সৌমিত্র ভক্ত”দের লড়াইয়ের গল্প।
আমাদের এক বন্ধু বড় পরিচালকের বই আমাদের ভালো না লাগলে বলত, তোরা কিস্সু বুঝিস না। এবং এক সময় এ ভাবেই আমাদের সেই বন্ধুর নাম দাঁড়িয়েছিল, “বোঝার আছে”। এ কথা মানতেই হবে যে, সেই “বোঝার আছে”র রাস্তা ধরেই পরিচালক তপন সিংহ আমাদের আলোচনায় আলতোভাবে প্রথম এলেন হারমনিয়াম সিনেমায় এবং ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লেন আদালত ও একটি মেয়ে সিনেমার পর। মানে এই সময় থেকেই ছবি এবং তার মূল চরিত্রগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিচালক তপন সিংহ আমাদের বাঁধানো রকে জাঁকিয়ে বসলেন। সহমর্মিতার আড়ালে থাকা কুটিল প্রশ্নে জেরবার পিতার এক টুকরো কাগজে লিখে রাখা “আমার ধর্ষিতা মেয়ে ভালো আছে” জাতীয় ট্রিটমেন্ট হাসির সঙ্গে যে বেদনার ছায়াটা না জানিয়েই ফেলে যায় – আমরা তাতে ডুবেছিলাম। এবং ওই সিনেমাটা (আদালত ও একটি মেয়ে) দেখে মনে হয়েছিল যে, তপন সিংহ ডাইরেক্টর হলে তার ছবির অভিনেতারা আসলে ডাইরেক্টর’স অ্যাক্টর। সে ধারণাটা দিন কয়েক আগে আরও উস্কে দিয়ে গেল সদ্য “দাদাসাহেব ফালকে” পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জবানী। কী বলেছেন সৌমিত্র? “একটা দৃশ্য ছিল যেখানে এক ভদ্রলোক অপ্রত্যাশিতভাবে একটা বড় অঙ্কের চেক কেটে দেবেন আমাদের। আমি চমকে দ্রুত মুখ তুলেছিলাম। তপনদা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে গেলেন, সৌমিত্র, মুখটা আস্তে আস্তে তুললে কিন্তু অবাক হওয়াটা আরও প্রাঞ্জল হবে”। ছবির নাম – সম্ভবত হুইলচেয়ার।
আমার মনে হয়, তপন সিংহের সোনালি বেলা ছিল আমাদের শৈশবে। তাই আজও ঘুরে ঘুরে আপনজন-এর ছায়াদেবীর কথা মনে পড়ে, কাবুলিওয়ালার ‘খোকি’ ডাক এখনও কানে বাজে, ক্ষুধিত পাষাণ-এর “সব ঝুট হায়” ভুলতে পারি না। বলা ভালো, একেবারেই ভালো লাগেনি বৈদূর্য রহস্য এবং রাজা (শেষাক্ত বইটি “এ” মার্কা, ফলে ওই বয়েসের লোভে পড়ে দেখতে গিয়েছিলাম আর কী!)
কে কী বলবেন আমি জানি না, তপন সিংহ পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় দু-টো ছবির নাম হল “এখনই” আর “গল্প হলেও সত্যি”। এক ঝাঁক ঝকঝকে ছেলেমেয়েদের দাপাদাপি আর মান-অভিমান ধরে রাখা “এখনই” ছবিতে স্বরূপ দত্ত, অপর্ণা সেন বা মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়কে ছাপিয়ে আমার মনে দাগ কেটে গেছে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের প্রাণবন্ত অভিনয়। ঢোলা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, এক আধুনিক কবি ( সে কালের বিচারে) চিন্ময়ের অভিনয়ে ভীষণ মূর্ত এবং আমি এমনকি আজকের যুগের নিরিখেও চরিত্রটাকে খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। আর “গল্প হলেও সত্যি” মানে রবি ঘোষ, মানে তুলনাহীন অভিনয় ( বিশেষ করে নারকেলের খোল দিয়ে কলতলা পরিষ্কার করার দৃশ্যটা আজও খুব মনে পড়ে), মানে পরতে-পরতে ভালো লাগা একটা সিনেমা। আমার ঘরে এ মুহূর্তে দু-জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আছে, যারা কবিতা ভালো না বাসলেও ভালোবাসে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ( কী আশ্চর্য!) আর ভালোবাসে সেকালে দু-টো ছবি, “গল্প হলেও সত্যি” আর “বসন্ত বিলাপ” (পরিচালক –দীনেন গুপ্ত)। দু’টো ছবিই এখনও সময়-সুযোগ পেলে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। একই সঙ্গে “আদমী অউর অউরত”এর কথা না বললেও অন্যায় হবে। খুব সুন্দর ছবি। মনে আছে “আতঙ্ক” ছবিটা আশীর দশক কাঁপিয়ে দিয়েছিল। “মাষ্টারমশাই, আপনি কিছুই দেখেননি” তখন সবার মুখে মুখে। বইটা আমারও খুব ভালো লেগেছিল। তবে দু-টো ব্যাপার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেক-আপ এবং শেষে এসে প্রায় জোর করে ইচ্ছেপূরণের গল্প ভালো লাগেনি। তবে এই খারাপ লাগা ব্যাপারটা আমার কাছে তপন সিংহের ছবিতে খুব, খুব কম এসেছে। আসার কথাও নয়। সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরিচালক তপন সিংহ একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছিলেন। এক কথায় তাঁর সমস্ত ছবি যেন একান্তে তাঁর সিগনেচার বহন করত।
২০০৯ এর ১৫ই জানুয়ারি হঠাৎ করেই হারমনিয়ামের বেলোটা ছিঁড়ে গেল অথবা সেদিন আসলে কিছুই হয়নি – পরিচালক তপন সিংহ আজও আমাদের মধ্যেই আছেন। মনে পড়ছে আমার বন্ধুর দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে আফশোস্, ইস্স্, আরেকটা আপনজন…
ছবি: ইন্টারনেট
Very nice analysis.
আলোচনাটা উপভোগ করলাম ও শেষে এসে তাঁরই ছবির নাম ব্যবহার করাটা দুর্দান্ত লাগল। একটা ছোট গল্পের শেষ বলার মত করে এর শেষকালকে আঁকা।